আমার বাচ্চা খায়নাঃ পর্ব-৩

নিজের হাতে খেতে শিখানো

১.৫-২ বছরের একটা বাচ্চা খেতে না চাইবার কিছু কারণ আছে, তার মধ্যে এক হল অতিরিক্ত জোরাজুরি তাকে খাবারের প্রতি ব্রীতশ্রদ্ধ করে তুলেছে আরেকটা হল এই বয়সী বাচ্চারা সাবলম্বি হতে চায়। ভাবে অন্যরা নিজে নিজে খায়, আমিও নিজে খাবো। “নিজে নিজে খাইবো, আমি করি-আমি করি, নিজে করব” এগুলো এই বয়সী বাচ্চাদের কমন ডায়ালগ। এই সময় আপনি যদি সময় বাচাতে তাকে খাইয়ে দিতে চান, সে সেটা মানবে কেন?
৬ মাস বয়স থেকেই আমি আমার বাচ্চাকে ডাইনিং টেবিলের পাশে ফিডিং চেয়ারে বসিয়ে আমাদের সাথেই খেতে দিতাম। যাতে আমাদের খাওয়া দেখে দেখে ও খাওয়া শিখতে পারে।আমরা যে খাবার মুখের কাছে ধরতেসি সেটা দেখে দেখে ও নিজেও সেটা করার চেষ্টা করতো। অবশ্যই শুরুতে বাচ্চা খাবার নিজে ধরে মুখে খেয়ে ফেলবেনা। প্রথমে খাবার দেয়ার পর ৫-১০ মিনিট আমি ওকে নিজের মতো করে খাবার খাওয়ার চেষ্টা করতে দিতাম।সে খেতে যেয়ে খাবার নিয়ে খেলা করতো , খাওয়ার চেষ্টাও করতো।এতে করে ধীরে ধীরে নিজের হাতে খাওয়ার অভ্যাস টা হয়েছে। ৫-১০মিনিট পর আমিই খাইয়ে দিতাম। তবে খেয়াল রাখবেন খাওয়াতে যেয়ে জোর করবেন না। তার চাওয়া অনুযায়ী খাওয়াতে যেয়ে অভুক্ত থাকবে এমন ভয় পাবার দরকার নাই, খিদা লাগলে চাহিদা হবেই।

খাবার খেতে গিয়ে চারপাশ নোংরা করলে

নিজ হাতে খাবার খেতে গেলে বাচ্চা চারপাশ নোংরা করবেই। এটা আশা করবেন না আপনার বাচ্চা এক দুমাসেই গুছিয়ে খাওয়া শিখে যাবে। আমার বাচ্চার বয়স প্রায় ১৯ মাস,সে এখন নিজ হাতে সব বেলার খাবার খায়। কিন্তু কিছু খাবার ফিডিং চেয়ারে পড়ে, কিছু চেয়ারের বাইরেও পড়ে যায়। আর খেতে যেয়ে জামা কাপড় নোংরা তো করেই।সেক্ষেত্রে আমি যেটা করি, বাচ্চাকে গরমের দিনে খালি গায়েই খেতে দেই। এতে খাবারের পর ভেজা কাপড় দিয়ে মুছিয়ে দিলেই হয়। শীতের সময় আমার একটা পুরোনো টিশার্ট পরিয়ে দিতাম, ওটাতেই যা খাবার মেখে যেতো।এরপর ধুয়ে নিতাম।খাবার নিচে পড়লে বারবার পরিষ্কার করাটা ঝামেলা।এজন্য ফিডিং চেয়ারের নিচে একটা পলিথিন বা কাগজ বিছিয়ে দেই। খাওয়া শেষে তুলে ফেলে দেই।

খাবার উগলিয়ে ফেলে দিলে

বাচ্চা খাবার না গিলে বমির মত ওয়াক করছে বা ফেলে দিচ্ছে এটা দেখে ভয়ে অনেকেই মাসের পর মাস লিকুইড, সেমি সলিড খাবার বাচ্চাকে দিতে থাকেন। এটা করার একেবারেই দরকার নেই। বরঞ্চ এভাবে উগলে ফেলে দেয়াটা বাচ্চার একটা স্বাভাবিক প্রটেকটিভ মেকানিজম। বাচ্চাকে যখন আস্তে আস্তে সলিড খাওয়াতে থাকবেন, অভ্যাস না থাকার কারণে ওর একটু আনকমফোর্টেবল লাগবে খেতে। দুয়েক দিন এভাবে উগলে ফেলার চেষ্টা করবে, ধীরে ধীরে শিখে গেলে আর এমন করবেনা। অনেক সময় বড় টুকরা মুখে গেলেও বাচ্চারা চেহারা লাল করে এমন করে, তাতে ভয় না পেলে খাবারটা বের করে আনলেই হবে।

শ্বাসনালীতে খাবার আটকে গেলে

কোভাবেই বাচ্চাকে আংগুরের সাইজের বা চিনাবাদাম সাইজের খাবার গোল করে দেয়া যাবেনা এতে চোকিং হবার রিস্ক অনেক বেশি। পপকর্ন ও ৫বছরের নিচের বাচ্চাদের দিতে নেই। চোকিং হয়ে গেলে এমন সিচুয়েশনে কি করবেন সেটার একটা ভিডিও লিংক দিয়ে দিচ্ছি। এটা আসলে বাচ্চার বাবা-মা, কেয়ার গিভার সবার জানা জরুরি যে চোকিং হলে কি করা দরকার।

কোনো খাবারে এলার্জি থাকলে

শুরুর দিকে একইসাথে অনেকগুলো খাবার না দেয়ার আরেকটা কারণ হচ্ছে কোনো খাবারে এলার্জি আছে কিনা সেটা আইডেন্টিফাই করা। পরপর ৩ দিন শুধু আলু, এরপরের তিনদিন শুধু গাজর, এরপরের তিন দিন শুধু ওটস এভাবে করে একটা একটা খাবার এড করতাম আর খেয়াল করতাম এলার্জিক রিয়েকশন হচ্ছে কিনা। কোনো খাবারে এলার্জি হচ্ছে এমন টা বুঝতে পারলে অবশ্যই সাথে সাথে সেটা খাবারের রুটিন থেকে বাদ দিয়ে দিতে হবে।

আজকের মত এতটুকুই। পড়ে কেমন লাগল কমেন্ট এ জানাবেন আর কোন প্রশ্ন থাকলে অবশ্যই জিজ্ঞাসা করবেন। ধন্যবাদ।

লিখেছেন-

MBBS, MSc, PGT (Dermatology)

Dr Ishrat Nazneen Metee

আমার বাচ্চা খায়নাঃ পর্ব-২

এই সিরিজের ১ম পর্বে , বাচ্চাকে খাওয়ানোর জন্য কি কি প্রোডাক্ট দরকার হতে পারে সেটা নিয়ে লিখেছিলাম। কেউ যদি আগের পর্ব মিস করে থাকেন এই লিংকে যেয়ে পড়তে পারবেন- আমার বাচ্চা খায়নাঃ পর্ব ১

এই পর্বে পুরোটাই লিখেছি বাচ্চার খাবার নিয়ে। আপনারা যারা গত পর্ব পড়েছিলেন, আপনাদের অনেকের কিছু প্রশ্ন ছিলো। এবার সেগুলোর উত্তর দেয়ারও চেষ্টা করেছি। আগামী পর্বে আর কি কি বিষয় নিয়ে লিখব সেটাও জানাতে পারেন কমেন্টে।

প্রথম কথাঃ ১বছর পর্যন্ত বাচ্চার প্রধান খাদ্য মায়ের বুকের দুধ কিংবা ফর্মুলা। ১ বছর পর্যন্ত গরুর দুধ ও দেয়া যাবেনা। আর যেহেতু প্রধান খাদ্য দুধ, তাই বাচ্চা দিনে ২ খানা ডিম খেলোনা, ১ বাটি খিচুড়ি খেলোনা, এই নিয়ে আফসোস এর প্রয়োজন নেই। এই সময়টা বাচ্চা খাবার নিয়ে খেলবে আর নানান খাবারের স্বাদ চিনবে, সলিড দেয়ার উদ্দেশ্য মূলত এটাই।

কখন থেকে বাচ্চাকে বুকের দুধ/ ফর্মুলার পাশপাশি অন্য খাবার দিয়েছি?

বাচ্চার ওজন যদি ঠিকঠাক থাকে তবে ৬ মাস পর্যন্ত তার জন্য বুকের দুধ/ফর্মূলাই যথেষ্ট। তবে যেহেতু ৪ মাস বয়স থেকে বাচ্চার আয়রন স্টোরেজ ধীরে ধীরে কমতে থাকে, তাই আমি সাড়ে পাঁচ মাস থেকে খুব অল্প অল্প করে আয়রন রিচড খাবার দিয়েছি। যেমন: খেজুর,টমেটো, মিষ্টি আলু, বীটরুট, ওটস।

কিভাবে নতুন খাবার ইন্ট্রোডিউস করেছি?

ট্র্যাডিশনালি এদেশে প্রায় সবাই ই নতুন খাবার হিসেবে খিচুড়ি দিয়ে শুরু করেন। খিচুড়িতে মাল্টি-গ্রেইন্স থাকে, হুট করে এতো জটিল খাবার বাচ্চার শরীর হজম করতে পারবেনা। এতোদিন আপনার বাচ্চা শুধুই দুধ খেত।তার জন্য দুধের গন্ধ ছাড়া অন্য কোনো খাবার যেমন পরিচিত না, তার পাকস্থলিও একইসাথে অনেক রকমে নিউট্রিয়েন্স হজম করে অভ্যস্ত না। এক্ষেত্রে আমি যেটা করেছি-
যেকোন একরকমের গ্রেইন, যেমনঃ চালের গুড়ো। চালের গুড়ো বাসায় বানিয়ে সিদ্ধ করে বুকের দুধ/ফর্মূলার সাথে মিশিয়ে পেস্টের মতো করে শুরুর দিকে দিতাম। এমনি করে সিদ্ধ মিষ্টি কুমড়ো, মিষ্টি আলু, ওটস এগুলো একটা একটা করে দুধের সাথে মিশিয়ে দিয়ে দিয়ে ইন্ট্রোডিউস করিয়েছি। এতে হয়েছে কি আমার বাচ্চার জন্য নতুন খাবার খেতে খুব একটা সমস্যা হয়নি। দুধের ফ্লেভার ওর পরিচিত ছিলো, আর যেকোন একটি নতুন খাবার খাওয়া শিখতেও তার সমস্যা হয়নি। প্রতিটা খাবার পরপর তিনদিন দিয়েছি কোন খাবারে এলার্জি আছে কিনা, সেটা বের করতে।

বাচ্চার মিল প্ল্যানিং

এখন আসি কীভাবে বাচ্চার মিল প্ল্যান করা যায় সেটা নিয়ে। কি কি খাবার দেয়া যেতে পারে, কীভাবে দেয়া যেতে পারে, এবং ডিউরেশন টা লিখে দেয়ার চেষ্টা করব। আমি মূলত দুইটা পদ্ধতি মিক্স করে বাচ্চার মিল প্ল্যান করতাম-

১) কনভেনশনাল পিউরে সিস্টেম

এই সিস্টেমেই শুরুতে বাচ্চাকে খাবার দেয়া ভালো। যেকোন খাবার সিদ্ধ করে , ম্যাশড করে সেমি লিকুইড বা লিকুইড করে দিলে বাচ্চার জন্য খেতে সুবিধা হবে। আগে যেটা বলছিলাম, সবজি সিদ্ধ করে দুধের সাথে দেয়া। এটা ছাড়াও ঘরে বানানো দই খেতে দিয়েছি। একটা জিনিস খেয়াল রাখতে হবে কিছুতে চিনি বা লবণ দেয়া যাবেনা। দইয়ের ক্ষেত্রেও টক দইটাই দিতাম, মাঝে মাঝে একটু খেজুর মিক্স করে দিতাম।নতুন একটা স্টাডিতে পড়েছি, ৬ মাসের বাচ্চাকেও পুরো ডিম (সাদা এবং কুসুম সহ) দেয়া যাবে। আমার বাচ্চাকে সাধারণত পোচ করে, স্ক্র্যাম্বল করে ডিম দিয়েছি। খেয়াল রেখেছি যাতে কুসুম শক্ত থাকে। সিদ্ধ ডিম খুব কম দিয়েছি কারণ সিদ্ধ কুসুম অনেক ড্রাই থাকে,গলায় আটকানোর সম্ভাবনা থাকে। রোলড ওটস বাচ্চার জন্য বেশ ভাল, আয়রন রিচ ফুড।

*অনেকে গরুর দুধ দেয়া যাবেনা ভেবে দই ও দেয়া যাবেনা ভাবেন। জানতে হবে, গরুর দুধের প্রোটিন বাচ্চা হজম করতে পারেনা কিন্তু দই তে সেটা ভেংগে স্বাস্থ্যকর ল্যাকটিক এসিড তৈরী হয় তাই গরুর দুধ আর দুধের তৈরী দই আদতে এক নয় এবং দইটা চিনি ছাড়া হলে বরং বাচ্চার জন্য ভাল। দইতে উপকারী ব্যাকটেরিয়া থাকে যেটা বাচ্চার হজমশক্তিতে সহায়ক।

২) বেবি-লেড উইনিং

বাচ্চাকে স্পুন ফিড, সেমি সলিড/পিউরে ফিডিং এর সম্পূর্ণ বিপরীত একটা পদ্ধতি বেবি লেড উইনিং। এই পদ্ধতিতে আপনাকে বাচ্চার পেছনে চামচ নিয়ে দৌড়ানোও লাগবেনা। আপনার বাচ্চা নিজে হাতে নিয়ে সলিড খাবার যাতে খাওয়া শিখতে পারে এটার জন্য বেবি লেড উইনিং পদ্ধতিটা বেশ কাজের। বাচ্চাকে পিউরে করে প্রথম কয়েক সপ্তাহ খাওয়ানোর পর ধীরে ধীরে পানি কম দিয়ে দিয়ে সলিড খাবারে অভ্যাস করানো শুরু করেছি। বেবি লেড উইনিং পদ্ধতি অনুযায়ী খাবার সেটা সবজি বা ফ্রু্টস যাই হোক সিদ্ধ করে আঙ্গুলের সাইজে কেটে নিতাম যাতে বাচ্চা ধরে ধরে খেতে পারে।
যেমনঃ কলা, আম, সিদ্ধ আলু, গাজর, ফুলকপি, মুরগির মাংস এগুলো ফিংগার সাইজের করে দিতাম। আলাদা করে বাচ্চার জন্য কিছুই তেমন রান্না করা হয়নাই। আমরা নিজেরা যেটা খাই, সেটাই তুলে নিয়ে খাবার পানিতে আধা ঘন্টা ভিজিয়ে তুলে দিতাম। এতে করে মসলা, তেল, লবন ধুয়ে যেত।তবে গরুর মাংস খুব একটা দেইনাই, উইকে একবার হয়তো দিতাম খুবই অল্প পরিমাণ, শুরু করেছি ৮-৯মাসে। এভাবে করে আস্তে আস্তে পুরো ম্যাশড থেকে সিদ্ধ করে নরম কিন্তু আস্ত খাবার দেয়া শুরু করি। এই প্রসেসটার সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে বাচ্চা মাড়ি দিয়ে চাবানো শিখে। এতে করে তার দাঁত সময়মতো গজানোর সম্ভাবনাও বাড়ে।

আজ এটুকুই। পড়বার জন্য ধন্যবাদ আর আপনার মূল্যবান মতামত জানাতে ভুলবেন না।

 

লিখেছেন-

MBBS, MSc, PGT (Dermatology)

Dr Ishrat Nazneen Metee